শনিবার । ৪ জুন ২০২২ । ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯ । ৩ জিলকদ ১৪৪৩
প্রথম আনল বিসিএসআইআর
দেশে হাইড্রোফুয়েল গাড়ি
আসিফ সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম
৪ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ |
জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহার করে গাড়ি চালনার যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পেট্রল, ডিজেল, অকটেন, হাইব্রিড এমনকি বিদ্যুত্চালিত গাড়ি ব্যবহার হয়ে আসছে বাংলাদেশে। কিন্তু হাইড্রোফুয়েল গাড়ি আমদানি এবং ব্যবহারের উদ্যোগ দেশে এই প্রথম। হাইড্রোজেনচালিত ‘টয়োটা মিরাই’ গাড়িটি কিনেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণাগার (বিসিএসআইআর)।
জাপান থেকে আনা গাড়িটি গত ২৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় করে চট্টগ্রামের বিসিএসআইআরে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশে জ্বালানিসাশ্রয়ী ও নবায়নযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে উন্নত দেশ গড়ার গবেষণার অংশ হিসেবে গাড়িটি প্রকল্পের আওতায় সরকারিভাবে কেনা হয়েছে। গাড়িটি বিসিএসআইআরের চট্টগ্রাম ক্যাম্পাসে পরীক্ষামূলক চালনা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ল্যাবে উৎপাদিত হাইড্রোজেন ফুয়েল (জ্বালানি) দিয়েই গাড়িটি চালানো হয়। নিরবচ্ছিন্ন চলাচলের জন্য একটি ফুয়েল পাম্প স্থাপন করা হবে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে।
দেশে হাইড্রোজেন ফুয়েল ব্যবহার করতে গবেষণা করছেন ড. মোহাম্মদ আবদুস সালাম। এই বিষয়ে বিদেশে ১০ বছরের উচ্চতর ডিগ্রি এবং গবেষণা শেষে দেশে ফেরেন সালাম। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ২০১৯ সাল থেকে দেশে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে সরকার ‘হাইড্রোজেন এনার্জি গবেষণাগার স্থাপন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন শুরু করে। ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয়ে প্রকল্পটি ২০২২ সালেই শেষ হওয়ার কথা। প্রকল্প পরিচালক ও সিনিয়র প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিসিএসআইআরের পৃষ্ঠপোষকতায় তার সফল বাস্তবায়ন দেশেই করতে পেরেছি। আমার উদ্দেশ্য শুধু গবেষণা নয়, এর সফল বাস্তবায়ন করেই জ্বালানির আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনা এবং পরিবেশবান্ধব একটি উন্নত দেশ গড়ে তোলা। ’
সালাম বলেন, বিশ্বের ২৪টি দেশ এখন হাইড্রোফুয়েল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের ২৫তম দেশ হিসেবে সেই উন্নত দেশগুলোর কাতারে উঠে আসা স্বাধীনতার ৫০ বছরে অন্যতম অর্জন। প্রযুক্তির দিক থেকে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা যে পিছিয়ে নেই, এটিই জানল বিশ্ব। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমি গাছের ডালসহ ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট থেকেই এই হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরি করেছি। এই জ্বালানি দিয়ে গাড়িটি প্রথম দিন ক্যাম্পাসে চালানো হয়েছে। ২০২২ সালের জুনে যে ফুয়েল পাম্প করব সেই হাইড্রোজেন তৈরি হবে পানি থেকে। তখন থেকে গাড়িটি নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাতে পারব। এরপর আমি রান্নাঘরের কিচেন কম্পোস্ট থেকেই তৈরি করব হাইড্রোফুয়েল। মূলত আমি দেখব দেশের কোন সহজলভ্য পণ্য থেকে বেশি পরিমাণে হাইড্রোফুয়েল তৈরি হবে। ’
জানা গেছে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ হাইড্রোফুয়েল ব্যবহারে জোর দিয়েছে। জাপান ও কোরিয়া ২০২৫ সালের মধ্যে গাড়ির বড় একটি অংশ হাইড্রোফুয়েলে চালানো নিশ্চিত করতে চায়। পাশের দেশ ভারতে ২০২০ সালে একটি হাইড্রোফুয়েল গাড়ি পরীক্ষামূলক চালানো হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশও এগিয়ে গেল।
বাংলাদেশে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহৃত ৮০ শথাংশ গাড়িই হলো রিকন্ডিশন্ড বা একবার ব্যবহৃত গাড়ি। যার প্রায় সবই আসে জাপান থেকে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করায় ইদানীং অবশ্য নতুন গাড়ির ব্যবহার বেড়েছে। বেড়েছে পরিবেশবান্ধব, জ্বালানিসাশ্রয়ী হাইব্রিড গাড়ি আমদানি ও ব্যবহার। সেদিক থেকে হাইড্রোফুয়েল ব্যবহার কতটা লাভজনক জানতে চাইলে আবদুস সালাম বলেন, ‘অকটেনে গাড়ি চলতে এক কিলোমিটারে খরচ হবে আট টাকা। আর হাইড্রোফুয়েলে এক কিলোমিটার গাড়ি চলতে জ্বালানি খরচ হবে সাড়ে সাত থেকে আট টাকা। জ্বালানি খরচ মোটামুটি একই। কিন্তু লাভটা হবে, বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তির গাড়িটি আমরা ব্যবহার করতে পারব। এতে জ্বালানিসাশ্রয় হবে। পরিবেশ দূষণমুক্ত হবে। একই সঙ্গে জ্বালানি আমদানিতে নির্ভরতা কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। ’
গাড়ি ব্যবসায়ীরাও সরকারি এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বারভিডার সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল মাহবুবুল হক চৌধুরী বাবর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মনে আছে, বিশ্বে যখন হাইব্রিড গাড়ির ব্যবহার শুরু হচ্ছিল, তখন দেশে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছিলাম। প্রায় ১০ বছর পর আমরা সেই গাড়ি আমদানি করতে পেরেছিলাম। এখন একেবারে শুরুতেই এই উদ্যোগ দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। ’
বাবর বলেন, ‘এই মুহূর্তে দেশের যে কারো হাইড্রোজেন গাড়ি আমদানির সুযোগ নেই। কারণ আমদানিনীতিতে সেই গাড়ি আনা যাবে না। গাড়িটি গবেষণা প্রকল্পে গবেষণার অংশ হিসেবে বিশেষ অনুমতিতে আনা হয়েছে। আমরা চাইব জ্বালানিসাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব এই গাড়ি আমদানি করে জনগণ যাতে ব্যবহার করতে পারে, সেই উদ্যোগ সরকার দ্রুত বাস্তবায়ন করবে। একই সঙ্গে গাড়িটির জ্বালানি, যন্ত্রাংশ সহজলভ্য করার উদ্যোগ নিতে হবে। ’
জানা গেছে, ‘হাইড্রোফুয়েল সেলসহ একটি গাড়ি জাপান থেকে আমদানি করতে সাধারণ গাড়ির চেয়ে দাম বেশি পড়ছে। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবহৃত গাড়িকে বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে হাইড্রোফুয়েলে রূপান্তর করতে পারলে আমাদের বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে। যেভাবে আমরা আগে পেট্রল, ডিজেল, অকটেনচালিত সাধারণ গাড়িকে সিএনজিতে রূপান্তর করেছিলাম। একইভাবে বর্তমানে এলপিজিতে রূপান্তর করেছি। ’